গাজী গোফরান: চট্টগ্রামের চকবাজারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে এস.এম. আনোয়ার সাদাত নামে একজন আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরও তাদের সহযোগী কিছু গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় এমন একটি ষড়যন্ত্রের চিত্র ফুটে উঠেছে। মতি টাওয়ার ও মতি কমপ্লেক্সের মালিক এস.এম. আনোয়ার সাদাত এই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
৩রা ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সকাল ১০টা থেকে চট্টগ্রামের চকবাজারস্থ মতি টাওয়ার ও মতি কমপ্লেক্সের সামনের ডিজিটাল আর.জি.বি ডিসপ্লে বোর্ডে একটি উস্কানিমূলক বার্তা প্রদর্শিত হতে শুরু করে। সেখানে লেখা ছিল, “হিন্দুত্ববাদ নিপাত যাক, হয় শরীয়াহ নয় শাহাদাত।”
এই ঘটনার পরপরই স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং সহিংসতার আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে সচেতন মহলের চাপে ওই দিন বিকেলেই আর.জি.বি ডিসপ্লে বোর্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই স্লোগান পরিকল্পিতভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে যাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তারা আরও জানান, দীর্ঘদিন ধরে মার্কেটের ৪২৫টি দোকানের প্রায় ১৫০০ দোকান মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রতি বজায় ছিল। কিন্তু এই ঘটনার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মার্কেটের ব্যবসায়ীরা প্রতিবেদককে বলেন, এই ঘটনায় মার্কেটের হিন্দু ক্রেতাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দু ধর্মালম্বী ক্রেতারা এ ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানির পর মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসার বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করতে পারেন। ফলে ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির শঙ্কায় রয়েছেন।
দোকান মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, "এটি অত্যন্ত পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মাধ্যমে চট্টগ্রামের স্থিতিশীল পরিবেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। আমরা এই ঘটনার ন্যায্য তদন্ত এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করছি।"
স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অভিযোগ করে বলেন, এস.এম. আনোয়ার সাদাত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে ব্যবসায়িক সুবিধা নিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রামের কে.কে. অটোমোবাইলস এবং মতি টাওয়ার ও মতি কমপ্লেক্সের মালিক।
আনোয়ার সাদাতের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রেখে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। গাড়ি আমদানিতে মন্ত্রীদের ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। এছাড়া জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ সরকারকে রক্ষার জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন।
বর্তমানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর তিনি চট্টগ্রামে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধিয়ে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এস.এম. আনোয়ার সাদাত এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, তিনি চকবাজার এলাকায় থাকেন না এবং ডিসপ্লে বোর্ডে প্রদর্শিত বার্তা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, "একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রাখা স্বাভাবিক। তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।"
এই ঘটনার পর মতি কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: শাহজাহান এবং মতি টাওয়ার ব্যাবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক সাক্ষরিত চকবাজার থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। চকবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ জানান, "আমরা অভিযোগ পেয়েছি এবং বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তে প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"
চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য পরিচিত। মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায় যুগের পর যুগ ধরে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে আসছে। কিন্তু এ ধরনের ষড়যন্ত্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে।
সচেতন মহল বলছেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু ব্যবসায়ী সমাজ নয়, পুরো দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রশাসনের দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ এ ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে অপরিহার্য।
0 মন্তব্যসমূহ