৩৬ বছর ইমামতির পর বর্ণাঢ্য আয়োজনে ইমামের রাজকীয় বিদায়

শফিকুল ইসলাম প্রতিনিধি:- কক্সবাজার সদরের খরুলিয়ায় এক মসজিদে টানা ৩৬ বছর দায়িত্ব পালনের পর মাওলানা নুরুল হক নামের এক ইমামকে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাজকীয় বিদায় জানানো হয়েছে। এ সময় অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে তাকে পেনশন হিসেবে সাড়ে ৮ লাখ টাকা দিয়ে বিরল সম্মাননা জানানো হয়। বিদায় বেলায় ইমামকে সম্মানিত করার এমন উদ্যোগের কারণে প্রশংসায় ভাসছেন প্রাক্তন ছাত্রসহ আয়োজকরা। শনিবার (১৩ জুলাই) সকালে খরুলিয়া কেন্দ্রিয় জামে মসজিদের মাঠে ইমামের সম্মানে এ বিরল বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিদায়ী ইমাম মাওলানা নুরুল হক পেকুয়া উপজেলার টেইটং ইউনিয়নের জালিয়ার চাং এলাকার বাসিন্দা। এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের দিকে মাওলানা নুরুল হককে মসজিদটিতে ইমামতির দায়িত্ব দেন। এরপর কেটে যায় প্রায় ৩৬ বছর। এ সময়ে তার উদ্যোগে মসজিদটিতে নানা সংস্কার হয়। পাশাপাশি খরুলিয়া তালিমুল কোরআন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়া খরুলিয়া নূরানী এন্ড ক্যাডেট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। প্রিয় ইমামকে বিদায় জানাতে গ্রামবাসীসহ তাঁর প্রাক্তন ছাত্ররা ওই মসজিদে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা এম আজিজুল হকের সভাপতিত্বে ও ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মিজানুল কবিরের পরিচালনায় ইমাম নুরুল হকের কর্মময় জীবনের ওপর আলোকপাত করে বক্তব্য দেন ব্যাংকার আনিসুল কবির, ইঞ্জিনিয়ার কায়ছার উদ্দিন, মোশারফফ হোসাইন, সমাজকর্মী জাহাঙ্গীর আলম শামস, ব্যবসায়ী আজিম খান, শিক্ষক আলতাব হোসাইন, সিরাজুল হক নিজামী, শিক্ষক আব্দুল্লাহ, মসজিদ কমিটির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আজিজ, মাষ্টার গোলাম কবির, মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলম, ইউপি সদস্য আব্দুর রশিদ, ইউপি সদস্য শরীফ উদ্দিন, সিঙ্গার রহিম, মসজিদ কমিটির সহ-সভাপতি মুস্তফা কামাল, মৌলানা আমিনুল হক, ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম শফিক প্রমূখ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিশেষ মেহমান হিসেবে খরুলিয়া কেন্দ্রিয় জামে মসজিদের খতীব মাওলানা মোহাম্মদ হাসান, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, শিক্ষক, আলেমেদ্বীনসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বৃহত্তর খরুলিয়ার ৭ গ্রামের বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণে পুরো খরুলিয়ায় উৎসবের আমেজ তৈরী হয়। বিশেষ করে খরুলিয়া সিএনজি চালক সমিতি, ফার্ণিচার ব্যবসায়ী সমিতি, বাজার ব্যবসায়ী সমিতি, মসজিদ কমিটি, এলাকাবাসী, প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ ও নুরানী ক্যাডেট মাদ্রাসার পক্ষ থেকে ক্রেস্ট এবং সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি খরুলিয়া তালিমুল কোরআন মাদরাসা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মরহুম মৌলানা মোহাম্মদ হোসাইন কে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। এসময় মুসল্লিরা বলেন, আমরা নামাজ কালাম শেখাসহ সামাজিক যাবতীয় সমস্যায় হুজুরের কাছ থেকে সমাধান নিতাম। হুজুর অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের এলাকার জন্য একজন অনুসরণীয় ব্যক্তি হয়ে থাকবেন। বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে আমাদের কাছ থেকে আজ বিদায় নিচ্ছেন যা আমরা মেনে নিতে পারছি না। স্থানীয় সমাজ কর্মী জিয়াউল হক জিয়া, আনিসুল কবির, শরিয়ত উল্লাহ, ফয়সাল মাহমুদসহ শত শত যুবক বলেন, আজকের দিনটি আমাদের জন্য বেদনার। কেননা আত্মার আত্মীয়কে বিদায় দিচ্ছি, যিনি দীর্ঘ ৩৬ বছর দ্বিনি শিক্ষায় আমাদের আলোকিত করেছেন। ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মিজানুল কবির বলেন, কক্সবাজার সদরে ইমামের এমন রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনা এই প্রথম। এর আগে কখনো উপজেলায় এমনভাবে কোনো ইমামকে বিদায় দেওয়া হয়নি। ইমাম সমাজের নেতা। নেতাকে রাজকীয়ভাবে বিদায় দিতে পেরে আমরা স্বস্তি পেয়েছি। বিদায়ী ইমাম নুরুল হক বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে এই মসজিদে ইমামতি করে আসছি। ৩৬ বছরের বিদায় বেলাতে এত ভালোবাসা ও সম্মান দেওয়ায় আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। এসময় চোখে ছিল পানি, তবুও স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে গ্রামবাসীর কাছে বিদায় নেন। বিদায় বেলায় তিনি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়া এবং ঈমান ও আমলের ওপর সবাইকে জীবন পরিচালিত করার আহ্বান জানান। হাদীস শরীফে রাসুল (সাঃ) আলেম-ওলামা, জ্ঞানী ব্যক্তি, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে বলে মন্তব্য করে অনুষ্ঠানের প্রধান মেহমান মাওলানা এম আজিজুল হক বলেন, আজকের এই অনুষ্ঠান সবার চক্ষু খোলে দিয়েছে। সকল মসজিদের দায়িত্বশীলদেরকে এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। দলমতের উর্ধ্বে উঠে সবাইকে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ব্যাপারে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার আহবান জানান। অনুষ্ঠান শেষে ইমামকে ফুল সুসজ্জিত প্রাইভেট কারে বসিয়ে মোটরসাইকেল বহর নিয়ে রাজকীয় সম্মানে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। বিদায়লগ্নে উপস্থিত হাজারো মুসল্লিসহ তাঁর ছাত্ররা আপ্লুত হয়ে পড়েন। এরআগে ওই ইমামকে সাড়ে ৮ লাখ নগদ টাকার পাশাপাশি নানা উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ