সিজার মহামারিতে আক্রান্ত চট্টগ্রামের জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতাল

আলট্রাসাউন্ড রিপোর্টে নরমাল ডেলিভারি রোগীকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সিজার

মো: মনছুর আলম: সারা দেশে অর্থের লোভে সিজার ডেলিভারি এখন প্রায় মহামারিতে রূপ নিয়েছে। ডিজিটাল যুগের অনলাইন গণমাধ্যম আর খবরের কাগজে কিংবা টিভির পর্দায় এমন মহামারিতে আক্রান্ত হওয়া তালিকায় ভূরিভূরি হাসপাতালের নাম দেখা যায় প্রায়শই। এমনই তালিকা থেকে বাদ যায়নি চট্টগ্রাম মহানগরের জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালও। প্রয়োজনীয় ডাক্তারী পরীক্ষা ও আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট অনুযায়ী নরমাল ডেলিভারিকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সিজার ডেলিভারি করা ভুক্তভোগী এক রোগীর ব্যাপারে লিখিত অভিযোগে এমনটা চিত্র উঠে আসে এই হাসপাতালের।

পরিসংখ্যান মতে, একসময় গ্রামগঞ্জে কোন কোন দম্পতির ১০-১২টা সন্তান হলেও, তা হত নরমাল ডেলিভারিতে তাও আবার ঘরে। আর এখন ডিজিটাল যুগে দেশে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাচ্চা ডেলিভারি করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিটি দেশের ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যায়ে মা ও শিশু হাসপাতাল সহ বিভিন্ন সাব সেন্টারে প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে, যেখানে নিরাপদ বাচ্চা ডেলিভারি করা সম্ভব। ২০২২ সালে ঘরে নরমাল ডেলিভারি শিশু জন্মদান হয়েছে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৩২৪ টা। সরকারি হাসপাতালে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৩৮ টা শিশুর জন্ম হয়েছে, যাদের মধ্যে সিজার হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮ টা। বেসরকারি হাসপাতালে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ২৫৫ টা শিশুর জন্ম হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯৪২ টা হয়েছে সিজার। আর এনজিও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৬১ হাজার ৪৮৯ টা শিশুর জন্ম হয়েছে, যাদের মধ্যে সিজারে হয়েছে ২২ হাজার ১৩৬ টা। এছাড়াও খরচের পরিসংখ্যান মতে, সরকারি হাসপাতালে ডেলিভারি করাতে খরচ হয় মোট ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ। বেসরকারিতে শতভাগই নিজেদের টাকায় ডেলিভারি করতে হয়। ২০২২ সালে সিজারে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে ৮৪ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে। বাকি ১৪ শতাংশ হয়েছে সরকারি হাসপাতালে আর ২ শতাংশ হয় এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। অথচ বর্তমান সময়ে এসে নরমাল ডেলিভারি প্রায়ই ধরতে গেলে শুন্যের কোটার কাছাকাছি নেমে আসতেছে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কালীপুর এলাকার বাসিন্দা জনৈক রাশেদুল হক তার গর্ভবতী স্ত্রী লিজা আক্তারকে বাচ্চা ডেলিভারির জন্য ভর্তি করান চট্টগ্রাম মহানগরের জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে আলট্রাসাউন্ড রিপোর্ট মোতাবেক কর্তব্যরত চিকিৎসক পরবর্তী ২৭ মার্চ নরমাল ডেলিভারির দিন ধার্য্য করেন। ঐ ধার্যদিনে কোন ধরণের পুনঃ পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই, দেরী করলে বাচ্চা কিংবা মা মারা যাওয়ার কথা বলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সিজার ডেলিভারি করেন রোগীকে।

রোগীর স্বামী রাশেদুল হক বলেন, আমার স্ত্রী লিজা আক্তারকে নিরাপদে নরমাল ডেলিভারি করানোর উদ্দেশ্যে সুদূর গ্রাম থেকে এসে চট্টগ্রাম শহরের জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে ভর্তি করাই। ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী সকল পজিশন স্বাভাবিক থাকায় নরমাল ডেলিভারির জন্য উপযুক্ত ছিল। এমন কি এই হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করে রিপোর্ট অনুযায়ী নরমাল ডেলিভারির দিনও ধার্য্য করে দেন। অথচ ডেলিভারির দিন রোগীকে স্যালাইন পুশ করার ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার এসে কোন প্রকারের টেস্ট ছাড়াই আধ্যাত্মিক ভাবে বাচ্চা পায়খানা খেয়েছে বলে, বাচ্চা কিংবা মা মারা যাওয়ার ভয় দেখিয়ে সিজার করাতে বাধ্য করেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরও হঠাৎ এমন সমস্যা হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডাক্তার বলেন, প্রেসক্রিপশনে দেওয়া স্যালাইনের পরিবর্তে আরেকটা পুশ করা হয়েছে তাই। এছাড়া স্যালাইন পুশ করা নার্সকেও বকাঝকা করে বলেন, তোমাদেরকে বলেছিলাম না? এই স্যালাইনে সমস্যা আছে, এই স্যালাইন গুলো কোন ডেলিভারি রোগীকে পুশ না করার জন্য! পরে ভুল চিকিৎসার সুষ্ঠু প্রতিকার চেয়ে আমার আপন ছোট ভাই আসিফ ইকবাল বাদী হয়ে স্ব শরীরে হাসপাতালের এডমিন আশরাফ উদ-দৌলা সুজনের বরাবর লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে তিনি জানান, রোগীর স্বামীকে বাদী হয়ে অভিযোগ করতে হবে সেক্রেটারি বরাবর, তখন আমি অভিযোগ রিসিভ করব। পরবর্তীতে রোগীর স্বামী রাশেদুল হক বাদী হয়ে এডমিনের কথানুযায়ী সেক্রেটারি বরাবর লিখিতঁ অভিযোগ দায়ের করেন। অর্থের লোভে মিথ্যা নাটক সাজিয়ে ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী লিজা আক্তারের সিজার ডেলিবারি করা হয়েছে বলে দাবী করেন আসিফ ইকবাল।

সরেজমিনে হাসপাতালের ২২৩ নম্বর কেবিন পরিদর্শনে রোগী লিজা আক্তার সাক্ষাতে বলেন, আমাকে 'কি যেন' একটা স্যালাইন পুশ করার ঘন্টা খানেক পরে ডিউটিতে থাকা ডাক্তার এসে নার্সকে বকাঝকা করে এবং নিচের ঔষুধের দোকানদারকেও ফোনকলে গালমন্দ করে জানতে চেয়েছেন, নিষেধ করার পরেও এই স্যালাইন ডেলিভারি রোগীর জন্য কেন দেওয়া হয়েছে! পরে তার অবস্থা খুব খারাপ জানিয়ে দ্রুত সিজার রুমে নিয়ে যান বলে জানান রোগী লিজা আক্তার। এছাড়াও তিনি আরো বলেন, তার পাশে থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের আরেক নরমাল ডেলিভারি রোগীকেও একই স্যালাইন পুশ করা হয়েছিল। ডাক্তার আসতে আসতে তার স্যালাইন পুশ করার বেশিক্ষণ না হওয়ায়, তাৎক্ষণিক সিজারের সিদ্ধান্ত না নিলেও পরবর্তীতে তাকেও সিজার করা হয়। রোগী লিজা আক্তারের সাথে সার্বক্ষণিক থাকা তার মাতা ফরিদা ইয়াছমিনও একই বক্তব্য প্রদান করেন।

রোগীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, হাসপাতালের নিচে মাদার'স কেয়ার ফার্মেসী'র ম্যানেজারের সাথে সাক্ষাতে কথা হলে তিনি জানান, রোগীকে পুশ করা লিব্রুসিন স্যালাইন আমরা এখন বিক্রি করিনা। কেন বিক্রি করেনা জানতে চাইলে বলেন, লিব্রুসিন স্যালাইনগুলো দোকান হতে সরিয়ে ফেলার জন্য ২৬ মার্চ নির্দেশনা পেয়েছি। এরপরও ২৭ মার্চ এই স্যালাইন কেন দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি বার বার কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর এদিকে হাসপাতালের পক্ষ থেকে স্যালাইন সংক্রান্ত বিষয়ে কোন ধরনের বক্তব্য না দেওয়ায়, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কেন ডেলিভারি রোগীকে এই স্যালাইন পুশ করা হয়েছে? কর্তব্যরত নার্স-ডাক্তার কিংবা কর্তৃপক্ষকে এমন প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি।

জেমিসন মাতৃসদন হাসপাতালের চীফ এডমিন অফিসার আশরাফ উদ-দৌলা সুজনকে সরেজমিনে অফিসে না পাওয়ায়, গত ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এই ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি, বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো। ভুল চিকিৎসায় সিজারের নামে অতিরিক্ত খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগীতো সকালে রিলিজ হয়ে চলে গেছে। তাছাড়া আপনি রোগীর কে হোন? রোগীর স্বামীতো এসব নিয়ে কিছু বলেনি, আপনি কেন এসব বিষয়ে কথা বলছেন? আগামীকাল সকাল ১১টায় অফিসে আসেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তার কাছ থেকে অভিযোগের বিষয়ে জানবো দূরের, উলটো প্রতিবেদককে নানা অবান্তর প্রশ্ন ছুড়ে দেন। এদিকে রোগীর স্বজনরা ৩১ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষায় থেকে কোন সমাধান না পেয়ে পুরো টাকা পরিশোধ করে বাড়ি ফিরেন। এছাড়াও অভিযোগের বিষয় নিয়ে সমাধানের আশায় দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রিলিজ না নিয়ে অপেক্ষায় থাকায়, এই কয়েকঘন্টা বেশি সময় হাসপাতালে অবস্থান করায় কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ফি দাবী করে রোগীর স্বজনদের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ায় বলে জানা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ