কুড়িগ্রামে কিশোরীদের আত্মরক্ষার জন্য মাঠে চলছে প্রশিক্ষণ


নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধিঃ

কুড়িগ্রামে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান এশা। কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুল পড়তে আসে। পথে ঘাটে বিভিন্ন সময় ইভটিজিং কিংবা হয়রানির খবরে ভেতরে ভেতরে অনেকটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল এশা। তবে দুর্বলতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে নিজেকে সুরক্ষায় একটি অনন্য মাধ্যম খুঁজছিল সে।

আত্মরক্ষার কৌশল আর খেলা হিসেবে কারাতে শেখার সংকল্প ধারণ করে এশা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের কোনও খোঁজ মিলছিল না। জেলা ক্রীড়া সংস্থাসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে কোনও আশ্বাস না পেয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছিল এই কিশোরী। এমন সময় খবর মিললো একটি সামাজিক সংগঠনের আয়োজনে মেয়েদের আত্মরক্ষা ও আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান করতে কারাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সুযোগ লুফে নেয় এশা। পরিবারের সম্মতি নিয়ে সপ্তাহব্যাপী সেই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে কারাতে আয়ত্ব করে অনেকটা আত্মবিশ্বাসী সে। আত্মরক্ষার কৌশল আয়ত্ব করতে পেরে অনেকটা উজ্জীবিত এশা কারাতেকে ধারণ করে আরও সামনে এগিয়ে যেতে চায়।

এশা বলে, ‘আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা নিজেকে রক্ষায় শারীরিক কৌশল রপ্ত করার। আত্মরক্ষায় কারাতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি কারাতে খেলায় অংশ নিয়ে জেলাকে ব্র্যান্ডিং করবো। আমার সেই প্রত্যাশা পূরণে পথ দেখালো এই প্রশিক্ষণ। শারীরিক কসরত হিসেবে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াতে কারাতে আমার মধ্যে অবিশ্বাস্য প্রভাব ফেলছে। আমি এটি চালিয়ে যেতে চাই। তবে এ জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা’ বলে এশা।

এশার মতো আরও ৩৬ জন কিশোরী এই কারাতে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে মেয়েদের খেলাধুলা করাটা এখনও অনেকটা ট্যাবুর (নিষিদ্ধ) মতো। সেখানে খেলা কিংবা আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে কারাতেকে ধারণ করার সিদ্ধান্ত এই কিশোরীদের জন্য পাহাড় ডিঙানোর মতো। তবে বেশ আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয় নিয়ে এই কিশোরীদের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে দেখা গেছে। কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বৃহস্পতিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বিকালে ৭ দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। শনিবার সনদ বিতরণের মাধ্যমে শেষ হবে মেয়েদের নিয়ে প্রথমবারের মতো এই আয়োজন।

প্রশিক্ষণ মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া কিশোরীদের বেশির ভাগই পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পড়ুয়া। দু’একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও রয়েছেন। কারাতে শিখতে অংশ নেওয়া তন্নী বণিক, মিথিলা, খাদিজা ও মনিকাসহ অন্য কিশোরীরা জানান, এটি একটি অসাধারণ খেলা। শারীরিক ব্যায়ামের পাশাপাশি এটি সবার আত্মরক্ষায় বেশ কাজে দেবে বলে তাদের বিশ্বাস। কিন্তু এটি ধরে রাখতে প্রয়োজন নিয়মিত প্রশিক্ষণ। অংশ নেওয়া কিশোরীদের দাবি, ‘সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে অনেকে কারাতে শেখার সুযোগ পাবে। পরিবার থেকেও অভিভাবকরা সাহস ও আস্থা পাবেন। প্রতিবছর ক্রীড়া সংস্থা থেকে কারাতে খেলার আয়োজন করা হলে জেলার মেয়েরা উৎসাহী হবে।’

মেয়েদের জন্য কারাতে প্রশিক্ষণের এই আয়োজন করেছে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন ভয়েজ-বহ্নিশিখা। গ্রিন ভয়েজের বহ্নিশিখা মূলত কাজ করে শিশু ও নারী অধিকার রক্ষা নিয়ে। আয়োজকরা জানান, আত্মনির্ভরশীলতায় নারী, সমাজবিদুষী নারী, আলোকিত নারী, প্রযুক্তিপূর্ণতায় নারী, বলীয়ান নারী, পরসেবায় নারী এবং ন্যায়পাল নারী—এই সাত ক্যাটাগরিতে নারীদের নিয়ে কাজ করে গ্রিন ভয়েজের বহ্নি শিখা। মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল ও আত্মবিম্বাস উন্নয়ন শীর্ষক এই কারাতে প্রশিক্ষণ মূলত ‘বলীয়ান নারী’ ক্যাটাগরির অংশ। ‘আত্মবিশ্বাসে আত্মরক্ষা’ স্লোগানে এ বছরের জানুয়ারি মাসে খুলনায় এই কারাতে প্রশিক্ষণের শুরু হয়। এরপর রংপুর হয়ে কুড়িগ্রামে কার্যক্রম পরিচালনা করা হলো। ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নোয়াখালী, সিলেট ও মাগুরা জেলাসহ সারাদেশে এই আয়োজন করা হবে বলে জানান আয়োজকরা।

গ্রিন ভয়েজের বিভাগীয় সমন্বয়ক মোনছেফা তৃপ্তি বলেন, ‘কারাতে আত্মরক্ষার কৌশল হলেও এটি মূলত একটি খেলা। মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোরা পাশাপাশি তাদের আত্মবিশ্বসের লেভেল বাড়াতে আমাদের এই আয়োজন। এই প্রশিক্ষণে আমরা কারাতে শেখার পাশাপাশি মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা মোকাবিলায় চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীদের পরমর্শের ব্যবস্থা রেখেছি। পুরো আয়োজনে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের প্রশিক্ষণ চলমান রাখতে চাই। তবে সরকারিভাবে মেয়েদের জন্য কারাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখলে জেলার মেয়েরা সহজেই এই খেলায় অংশ নিতে পারবে। জানতে চাইলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘কারাতে প্রশিক্ষণে মেয়েদের প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে। আমরা জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে একটা উদ্যোগ গ্রহণ করবো যাতে জেলার মেয়েরা নিয়মিত কারাতে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। মেয়েদের কারাতে প্রশিক্ষণের আয়োজনে সার্বিক সহযোগীতায় ছিলেন বনলতা দাস সুমনা এবং প্রশিক্ষক ছিলেন ব্লাক বেল্ট দ্বিতীয় ডান প্রাপ্ত খাজা ইউনুস ইসলাম ঈদুল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ