রাশেদ কুড়িগ্রামঃ
কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বসতভিটা নেই এ যুগের আলপনার। তাই দুই সন্তান এবং অসুস্থ্য স্বামিকে নিয়ে সংসার পেতেছেন একটি চৌকিতে। চৌকির সাথে বাঁশের খুটি বেঁধে পলিথিন এবং ছেড়া কাপড় দিয়ে মুড়ে তৈরী করেছেন তাদের থাকার বাড়ি। তাও আবার অন্যের বাড়ির পিছনে গরুর গোয়াল এবং টয়লেটের কাছে।
চৌকি বাড়িটি দেখতে গৃহপালিত পাখির বাসা মনে হলেও এখানেই গাদাগাদি করে রাত্রে ঘুমায় পরিবারের চার সদস্য। এর মাঝে বসেই পড়ালেখাও সারে পরিবারের বড় সন্তান নূরানী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। সরকার ভূমিহীনদের ঘর তৈরী করে দিলেও তালিকায় নাই কুড়িগ্রামের এই মানবেতর জীবনযাপন করা পরিবারটি।
এই চৌকি বাড়িটির অবস্থান কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভের খাষ ইউনিয়নের হাছিপাড়া গ্রামে। এই গ্রামের বাসিন্দা আজিজার রহমানের বাড়ির গোয়াল ঘর এবং টয়লেটের মাঝখানে এক টুকরো ফাঁকা জায়গা। সেখানে খোলা আকাশের নিচে একটি চৌকি পাতা। চৌকির সাথে আটকানো বাঁশের খুটিতে পলিথিন এবং ছেঁড়া কাপড়ে মোড়ানো উপড়ে পলিথিনের ছাঁদ।
পাঁচ ফিট দৈর্ঘ এবং ৪ ফিট উচ্চতার চৌকি ঘরটিতে বসবাস করেন চার সদস্যসের একটি পরিবার। পরিবারে কর্তা সেকেন্দার আলী অসুস্থ তাই সংসারের হাল ধরেছেন কর্তী আলপনা বেগম। সংসারে রয়েছে দুই সন্তান। বড় মেয়ে আট বছরের সাথী আক্তার স্থানীয় নূরানী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে রাকিব হাসান বয়স দুই বছর।
বিশ বছর আগে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারায় আলপনার বাবা। পরবর্তিতে দরিদ্র পরিবারে বিয়ে হয় আলপনার। আলপনার স্বামী দিনমুজুর এবং মৌসুমি রিকশা চালক। বিভিন্ন সময়ে উদ্বাস্তু হয়ে বিভিন্ন শহরে দিনরাত পার করেছেন তারা।
করোনার আগে রংপুরে স্বামী রিকশা এবং নিজে অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবন ধারন করলেও লকডাউনে ফিরে আসতে হয় নিজ গ্রামে। চাচার বাড়ির কোনায় এভাবেই ৭ মাস আগে স্থান হয় তাদের। একটি চৌকি পলিথিনে মুড়ে তৈরী করেছেন নিজেদের বাড়ি। এই চৌকি বাড়িটিতেই গাদাগাদি করে রাত পার করেন তারা।
এখানেই বসে পড়াশোনাও করে নিতে হয় বড় সন্তান সাথীর। রাতে শেষ সম্বল গুলোও তুলে রাখতে হয় এখানেই। কখনো বসে আবার কখনো আধসোয়া হয়ে রাত পার করতে হয় তাদের। দুঃসহ এই জীবনের ভার আরো অসহনিয় হয়ে উঠেছে। স্বামী নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অক্ষম হয়ে পড়েছে। এখন একমাত্র উপার্জন করেন আলপনা। কখনো দিনমুজুরি আবার কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে দুমুঠো ভাত যোগানোর চেষ্টা করেন তিনি। তবে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনির আওতায় প্রচলিত প্রকল্পে নাম নেই তার।
আলপনা জানান, স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানদের কাছে অনেক ঘুরেও কোন সহযেগিতা পাননি তিনি।একদিকে মাথা গোজার ঠাই নাই অন্য দিকে চারজনের খোরপোষ যোগানো কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠেছে।আলপনার স্বামী সেন্দোর আলী জানান, অতিকষ্টে এই চৌকিতে দুই সন্তানসহ চার জনের রাত পার করতে হয়। এই দুঃখের কথা লজ্জায় কাউকে জানাতে পারেননি তিনি।
নূরানী মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাথী আকতার জানান, রাতে এখানে ঘুমাতে তার অনেক কষ্ট হয়। তাছাড়া রাতে এখানে বসে কুপির আলোতে লেখাপড়া করতেও কষ্ট হয়। আলপনার চাচা আজিজার রহমান জানান, আলপনাদের কোন জমি নাই। তিনি এখানে থাকার জায়গা দিয়েছেন কিন্তু তাদের ঘর তুলে থাকার মতো কোন সামর্থ নাই।
এলাকাবাসী মাইদুল ইমলাম, আবিয়া বেগম, জিয়া মিয়া, সাইদুল ইসলাম জানান, পরিবারটির দুর্দশার কথা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানলেও পরিবারটির জন্য নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। এমনকি সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প থাকলেও বঞ্চিত এই পরিবারটি।
বল্লভের খাষ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান আকমল হোসেন বলেন, পরিবারটি নিত্যান্তই অসহায়। তদের বসত ভিটা এমনকি থাকার ঘরও নেই। খোলা আকাশের নিচে পলিথিন মোড়ানো একটি চৌকিতে বসবাস করছেন তারা।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আহমেদ মাছুম জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীনদের গৃহনির্মাণ চলমান রয়েছে। আলপনা বেগমকে এই প্রকল্পে জমিসহ একটি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে।
0 মন্তব্যসমূহ