কামরুল ইসলাম কামু পঞ্চগড় প্রতিনিধিঃ
পঞ্চগড় সদর উপজেলায় দুটি প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত মাদ্রাসার নাম জালিয়াতি করে নতুন দুটি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা গড়ে উঠেছে। পূর্বের ইবতেদায়ী মাদ্রাসা থেকে পরবর্তীতে দাখিল পর্যায়ে উন্নীত হওয়া মাদরাসা দুটির নাম সদর উপজেলার সাতমেড়া ইউনিয়নের ডুবানুচী বরকতিয়া দাখিল মাদরাসা ও শুরিভিটা দাখিল মাদরাসা। একটি চক্র ওই দুটি মাদ্রাসার নামসহ বিভিন্ন কাগজপত্র জালিয়াতি করে জাতীয়করণের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, এরই মধ্যে চক্রটি নিয়োগ বাণিজ্যের নামে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে ইতোমধ্যে এই দুটি ইবতেদায়ী মাদ্রাসার তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে পাঠানো হয়েছে। প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দিনদুপুরে নাম ও কাগজপত্র জালিয়াতি করে হঠাৎ গড়ে তোলা মাদরাসা দুটি নিয়ে সচেতনমহলে প্রশ্ন উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়নের ডুবানুচী গ্রামে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা। ডুবানুচি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বোরকা নদীর নাম মিলিয়ে নামকরণ করা হয় মাদ্রাসাটির। মাদ্রাসাটি ১৯৯৪ সালে দাখিল পর্যন্ত একাডেমিক স্বীকৃতি পায়।
এরপর থেকে ওই মাদ্রাসার নামকরণ হয় ডুবানুচী বরকতিয়া দাখিল মাদ্রাসা। কিন্তু হঠাৎ ২০১৮ সালে হুবহু ‘ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদরাসা’ নামে দিয়ে স্বতন্ত্র মাদরাসা গড়ে উঠে ওই মাদরাসার ২০ কিলোমিটার দূরে একই উপজেলার কামাতকাজল দিঘী ইউনিয়নের খারুয়া গ্রামে।পঞ্চগড় সদর ইউনিয়নের শুরিভিটা গ্রামে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা।
গ্রামের নামের সঙ্গে হাসনাইন পীরের নাম ও জমিদাতা নজির উদ্দিনের নামানুসারে মাদ্রাসাটির নামকরণ করা হয়। মাদ্রাসাটি ২০০১ সালে দাখিল একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। মাদ্রাসাটি দাখিল পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পর এর নামকরণ করা হয় শুড়িভিটা দাখিল মাদ্রাসা। কিন্তু গত বছর হুবহু ‘শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা’ নামে স্বতন্ত্র মাদ্রাসা স্থাপন করা হয় ওই মাদ্রাসা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে একই উপজেলার কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের বন্দেরপাড়া গ্রামে।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী থেকে দাখিল উন্নীত হওয়ার পর আগের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার নামে একটি চক্র মাদ্রাসা দুটির হুবহু নাম ও বিভিন্ন কাগজপত্র জালিয়াতি করে নতুন করে ওই দুটি মাদরাসা স্থাপন করেছে। নতুন কোন ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের তালিকায় স্থান পাবে না, তাই এই পুরনো মাদ্রাসার নাম ব্যবহার করার কৌশল নেয় প্রতারক চক্র। তবে বিতর্ক এড়ানোর জন্য জালিয়াতি করে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা দুটির কোনটিতে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়নি। স্থানীয়রা বিষয়টি নিয়ে বিস্মিত।
হঠাৎ করে আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো গড়ে তোলা দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তারাও কিছু জানে না। মাদ্রাসা দুটির নামও জানেন না তারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদরাসা দুটি নামের যুক্ত কোন স্থান বা ব্যক্তি নেই ওই এলাকায়। এমনকি মাদ্রাসার নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরাও জানেন না কোথা থেকে দেওয়া হলো এই নাম। ভুয়া মাদ্রাসা দুটির পক্ষে যেসব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশই জাল। জমি রেজিস্ট্রির দলিলটিও জাল।
২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মাদরাসা দুটির প্রতিষ্ঠাকাল দেখানো হয়েছে ১৯৬৫ সাল।
জানা গেছে, পুরনো তারিখের পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ। প্রতিটি শিক্ষকের কাছে নেওয়া হয়েছে তিন থেকে চার লাখ টাকা। এছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজস্যে তারা ব্যানবেইসে ভুয়া তথ্য সরবরাহ করেছে। ৬টি আধাপাকা কক্ষ সম্বলিত ভবনের কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে একটি তিন কক্ষের টিনশেড ও টিনের বেড়ার ঘর ছাড়া কিছু দেখা যায়নি।
শিক্ষার্থীদের যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে সেটিও কেবল কাগজে কলমে। কোন কাগজপত্র যাচাই না করেই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও সাবেক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ব্যানবেইসের তথ্য প্রেরণের কাগজে স্বাক্ষর করেছেন। ভুয়া কাগজপত্রের ওপর ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে প্রতারক চক্র। বাস্তবে কোন একাডেমিক কার্যক্রম না থাকলেও এবার ওই দুটি মাদ্রাসা থেকে ১৬ জন করে শিক্ষার্থীর চলতি বছরের ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষার জন্য তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রত্যয়ন পেয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিস ওই দুই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ডিআর জমা নিয়েছে। এমনকি কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই বাচাই করে স্বতন্ত্র মাদ্রাসার যে তালিকা পাঠিয়েছেন তার শুরুর দিকেই রয়েছে জালিয়াতি করে গড়ে তোলা মাদ্রাসা দুটির নাম।
কামাতকাজলদিঘী ইউপি সদস্য নুরে আলম বলেন, আমরা জানিনা কিভাবে কোথা থেকে মাদ্রাসা দুটি হলো। মাদ্রাসার নামগুলোও কারা ঠিক করলো তাও আমাদের জানা নেই। খারুয়াগ্রামের ফজল ও বন্দেরপাড়ার মিজানুর মাদরাসা দুটি স্থাপন করেছে। ২০১৮ সালে হয়েছে খারুয়াগ্রামেরটা আর গত বছর হয়েছে বন্দেরপাড়ার মাদ্রাসাটি।
কামাতকাজলদিঘী ইউপি চেয়ারম্যান মোজাহার আলী বলেন, এক দুবছর আগে মাদ্রাসা দুটির ঘর তোলা হয়। এর আগে কখনো মাদ্রাসা দুটির অস্তিত্ব ছিল না। মাদ্রাসা দুটি যে নাম ব্যবহার করা হয়েছে সেই নামে আমাদের এলাকায় কোন জায়গা বা ব্যক্তির নাম নেই। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার। ১৯৬৫ সালের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।
নতুন প্রতিষ্ঠিত ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, মাদ্রাসাটি অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত। তবে গত বছর থেকে ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। ১৯৬৫ সালের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা কেন ২০১৯ সালে প্রথম ইবতেদায়ীতে অংশ নিলো এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেননি তিনি। মাদ্রাসার নামের বিষয়ে বলেন, মাদ্রাসার আশপাশের ওইটুকু জায়গা আমরা ডুবানুচী বলি। বরকতিয়ার শব্দটির কোন তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
ওই মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফজল হক জানান, ২০১৮ সালে মাদ্রাসা করার জন্য জমি দেন তিনি। মাদ্রাসার নাম জানা নেই তার। তার এক ছেলেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে মাদ্রাসায় চাকুরি দেওয়া হয়েছে। আরেক ছেলে অন্য মাদ্রাসাটির প্রধান শিক্ষক। জয়নুল নামের এক ব্যক্তি মাদ্রাসা দুটি স্থাপনের সহযোগিতা করছেন। দুটি মাদ্রাসারই কাগজপত্র তৈরি শুরু করে সব অফিসে যোগাযোগসহ দৌড় ঝাঁপ সবকিছু করছেন ওই ব্যক্তি বলে জানান তিনি।
শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, শুরি নামে এক লোক ছিল তার নামের এই মাদ্রাাসা হয়েছে। হাসনায়নীয়া ও নজিরিয়ার শব্দ দুটির বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেন নি। একই নামে একাধিক মাদ্রাসা থাকতে পারে বলেও দাবি করেন তিনি।
ডুবানুচী বরকতিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার আজিজুর রহমান বলেন, আমাদের মাদ্রাসার নাম নকল করে অন্য এলাকায় স্বতন্ত্র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন খবর শুনে আমরা সত্যিই বিস্মিত। প্রতিষ্ঠিত একটি মাদ্রাসার নাম জালিয়াতি করে কিভাবে তারা মাদ্রাসা স্থাপন করতে পারে আমাদের মাথায় আসে না। আমরা সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানাই যেন বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়।
শুরিভিটা দাখিল মাদরাসার সুপার মো. সাইফুল্লাহ বলেন, আমাদের মাদ্রাসার নাম জালিয়াতি করে কামাতকাজল দিঘী ইউনিয়নের একটি গ্রামে স্বতন্ত্র মাদ্রাসা করা হয়েছে বলে জেনেছি। কিন্তু তারা এত বড় জালিয়াতি করলো, কিন্তু কেউ বিষয়টি টের পেল না এটিই বড় আশ্চর্যের বিষয়। পঞ্চগড় সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন বলেন,
এসব বিষয় দেখে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস। আমরা শুধু উপবৃত্তি ও পরীক্ষার বিষয়টি দেখি। আমাদের কাজের চাপ থাকায় স্বতন্ত্র মাদ্রাসাগুলোর ভাল করে পরিদর্শনের সুযোগ হয় না। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামানিক বলেন, আমরা ওই মাদ্রাসাগুলোর কাগজপত্র চেয়েছিলাম। একটি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে আরেকটি এখনো দেয়নি। কাগজপত্র পেলেই তা যাচাই করে দেখা হবে।
তদন্তের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন পরীক্ষা দিতে পারে তাই আমি প্রত্যয়ন দিয়েছি। তবে ব্যানবেইসে ভুল তথ্য প্রেরণে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আকতার বলেন, স্বতন্ত্র মাদ্রাসাগুলোর বিষয়ে মূল ভূমিকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। তারা যে তথ্য দেন আমরা সেগুলো পাঠিয়ে দেই মাত্র। পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ হোসেন বলেন, আমি সবেমাত্র এখানে যোগদান করেছি।
বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি এ বিষয়ে খোঁজ নেব। কোন অনিয়ম এবং জালিয়াতি প্রমাণিত হলে আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল মান্নান বলেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে স্বতন্ত্র মাদ্রাসার যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই বাচাই করে পাঠানো হয়েছে। জালিয়াতি করার বিষয়টি আমাদের জানা নেই।
তবে এমনটি করে থাকলে নিশ্চয়ই সেই তথ্য আমরা কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে প্রেরণ করতে পারবো।
0 মন্তব্যসমূহ