আশরাফুল
ইসলাম গাইবান্ধাঃ
গাইবান্ধা
জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তার ২৫ শত টাকার
তালিকাতে ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা
অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলার ১১ ইউনিয়নের প্রায়
৭ হাজার পরিবারকে সহায়তা দিতে উপজেলা প্রশাসনের কাছে যাচাই-বাছাই করা খসড়া তালিকা জমা দেন জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু সেই তালিকা প্রকাশের পর বিশ্লেষণ করে
নানা ধরণের চাঞ্চল্যকর তথ্য ছাড়াও বিভিন্ন গড়মিল আর অসঙ্গতির চিত্র
উঠে আসে। কয়েক দফা যাচাই-বাছাইয়ের পরেও জনপ্রতিনিধিদের এমন তালিকার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্রই আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টিসহ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এলাকাবাসী।
অধিকাংশ ইউনিয়নের তালিকাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তার আত্মীয়-স্বজন, আ’লীগ ও
অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবারসহ পছন্দের লোকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রকৃত দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের
নাম বাদ গেলেও তালিকায় ঠিকেই উঠেছে বড় ব্যবসায়ী, পাকা
বাড়ি-গাড়ির মালিক, স্বচ্ছল আর বিত্তশালীদের নাম।
এমনকি তালিকাতে অবসপ্রাপ্ত চাকুরীজীবি, সরকারী-বেসরকারী স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি এবং একই পরিবারের একাধিক স্বচ্ছল ব্যক্তির নামও আছে।
এছাড়া এই অর্থ হাতিয়ে
নিতে অনেক জনপ্রতিনিধি এবং দলের নেতা নিজের ও স্বজনদের একই
মোবাইল নম্বর দুই-তিনবার এমনকি আটবারও জুড়ে দিয়েছেন অনেক দরিদ্র মানুষের নামের পাশেও। ইতোমধ্যে তালিকাভুক্ত এসব সুবিধাভোগীর কেউ কেউ মোবাইল ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে ২৫ শত করে
টাকাও পেয়েছেন।
সাদুল্লাপুর উপজেলার বনগ্রাম, দামোদরপুর, জামালপুর, কামারপাড়া ও রসুলপুরসহ কয়েকটি
ইউনিয়নের তালিকা যাচাই ও বিশ্লেষণে সবচেয়ে
বেশি অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও নয়-ছয়ের
তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে ১১নং খোর্দ্দকোমরপুর ইউনিয়নের ৫৯৪ জনের নাম, তালিকায়। তালিকা অনুসন্ধানে দেখা যায়, আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও নিজের পছন্দের অনেক ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্তের অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী শামীমের বিরুদ্ধে।
সহায়তার এই অর্থ হাতিয়ে
নিতে তালিকার ৩২১ নম্বরে তিনি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রী, ৩৫২ ও ৩২২ নম্বরে
রিনা ও নাজমা নামে
সংরক্ষিত দুই নারী সদস্যকে বানিয়েছেন কৃষক ও দিনমজুর। তালিকার
২২০, ২২৭ ও ২২৯ নম্বরে
ওই দুই ওয়ার্ড সদস্যর তিন ছেলের নামও রয়েছে। পাশাপাশি তালিকার ১৮১ ও ৩১২ নম্বরে
খতিজা ও নাহিন নামে
দুই দরিদ্রর নামের পাশে আছে স্ত্রী ও মেয়ের মোবাইল
নম্বর ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, তালিকার ২০০, ২৬৭, ২৮৩, ৩০৩, ৩০৪, ৩০৮, ৩১০ ও ৩১১ নম্বরসহ
হতদরিদ্র অন্তত ১২ জনের নাম
ও ভোটার আইডি কার্ড ঠিক থাকলেও চেয়ারম্যান তার
(ব্যক্তিগত কাজের লোক রাজ্জাকের ০১৭৮৯৪৮৪০২৯ এবং আরও তিনটি নম্বর মোবাইল জুড়ে দিয়েছেন তাদের নামের পাশে। এরমধ্যে চেয়ারম্যানের মেয়ে এবং ব্যক্তিগত কাজের লোক রাজ্জাকের মোবাইল নম্বরে টাকাও এসেছে। আর ২৯১ নম্বরে
ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক
মোহাম্মদ আলী, ৫৪৬ নম্বরে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক নুর আলম ও ৪২৮ নম্বরে
ইউনিয়ন কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক এছাহাক আলী তালিকা নাম অন্তর্ভক্ত করে নিজেই সেজেছেন হতদরিদ্র আর দিনমজুর। তালিকার
১৯৪ নম্বরে অন্য সুবিধাভোগীর নামের পাশে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন এছাহাক আলী।
পাশাপাশি তালিকার ৫৪৫ নম্বরে আ’লীগ নেতা
মোহাম্মদ আলীর আপন ভাই মাহাবুর ও ২৪১ নম্বরে
তারই স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের নামও আছে। তালিকার ২৬৯ ও ২৭০ নম্বরে
রয়েছে রবিউল ও লৎফর নামে
সহোদর দুই ভাই। অথচ তারা দুইজনেই অবসরপ্রাপ্ত চাকুরীজীবি এবং এলাকাতে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত হলেও তালিকাতে কৃষক পেশা উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া তালিকার ৩৪৩ ও ৩৪৯ নম্বরে
বাবা-ছেলে, ৩৪০ ও ৩৪৪ নম্বরে
মা ও ছেলে, ৫৮,
৫৯, ২৪১, ৫৪৫ ও ৪৯৩ এবং
৪৫৮ নম্বরে আছে স্বামী-স্ত্রীর নামও। তালিকার ২৪৭ নম্বরে ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা, ৪৬২ নম্বরে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মচারী, ২৫০ নম্বরে হাইস্কুলের কর্মচারী, ৪৫৭ নম্বরে সরকারী ঘর ও রেশন
কার্ডের সুবিধাভোগীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
৪৯৩ ও ৪৯৪ নম্বরে
দুইজনের নাম থাকলেও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে অন্য ব্যক্তির এমনকি ১৮৫ নম্বরে থাকা ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে বগুড়া গাবতলীর মহিষবান মধ্যপাড়ার অন্য একজনের। এসব ছাড়াও পুরো তালিকাজুড়েই চাকুরী, ব্যবসা, সম্পদশালী আর আ’লীগ-অঙ্গসংগঠনের নেতা-স্বজনসহ প্রবাসী ব্যক্তির নামও।
স্থানীয়
এলাকাবাসী ও একাধিক ভুক্তভোগীর
অভিযোগ, প্রৃকত হতদরিদ্রদের বঞ্চিত করে আত্মীয়-স্বজনসহ নিজের পছন্দের লোকজনের তালিকা করেছেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী শামীম। তালিকায় নাম থাকলেও মোবাইল নম্বর জালিয়াতির করে চেয়ারম্যান তার পরিবারের লোকজন ছাড়াও ব্যক্তিগত লোকজনের মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে বিশেষ সহায়তার এই অর্থ হতিয়ে
নিয়েছে।
সরেজমিনে
ফুলবাড়ি গ্রামের হালিম বলেন, ‘২৫০০ টাকা পাওয়ার চেয়ারম্যান তাদের কাছে ৫০০ টাকা করে দাবি করেন। পরে পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যানের হাতে ৫০০ টাকা দেন তিনি। তার মতো চেয়ারম্যান অনেকের কাছে দাবি করে টাকা আদায় করছেন’। একই গ্রামের
ভোলা শেখ বলেন, ‘চেয়ারম্যানের দাবি করা ৫০০ টাকা দিতে পরিষদে যান তিনি।
এসময় চেয়ারম্যান না থাকায় তার
পিএস রাজ্জাকেবর কাছে প্রথমে ২০০ ও পরে আরও
২০০ টাকাসহ মোট ৪০০ টাকা দেন। এছাড়া একই গ্রামের বিধবা রোকেয়া বেওয়া বলেন, ‘৫০০ টাকার জন্য চেয়ারম্যান তার বাড়িতে মাহাফুজা নামে এক মেয়েকে পাঠায়।
পরে মাহাফুজার কাছে ৫০০ টাকা দেন তিনি’। ফুলবাড়ি গ্রামের
চামেলি বেগম বলেন, ‘তার শশুর নানা রোগে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন।
শাশুড়িসহ তার ভোটার আইডি কার্ড ও মোবাইল নম্বর
চেয়ারম্যানকে দিয়ে আসেন। কিন্তু তালিকায় তাদের নাম উঠলেও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত লোক রাজ্জাকের। এমন প্রতারণার জন্য রাজ্জাক ও চেয়ারম্যানের শাস্তির
দাবি জানান তিনি’। এছাড়া সুইটি
নামে অপর এক নারী জানান,
তালিকাতে তার নাম ও ভোটার আইডি
নাম্বার ঠিক থাকলেও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে রাজ্জাক নামের একজনের। তার টাকা হাতিয়ে নিতে চেয়ারম্যান ও রাজ্জাক পরিকল্পনা
করে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন বলেও অভিযোগ তার’।
গাছুর
বাজার এলাকায় লাভলু নামে অপর এক ভুক্তভোগী বলেন,
‘প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ২৫০০ টাকার তার মোবাইলে ম্যাসেজ আছে। পরে চেয়ারম্যান তার নাম্বারে ফোন করে এসময় তার স্ত্রীর কাছে মিষ্টি খাওয়ার জন্য টাকা দাবি করেন। চেয়ারম্যান তার স্ত্রীকে নানা খরচ ও সমস্যার কথা
বলে এ টাকা দাবি
করেন। চেয়ারম্যানের টাকা দাবির কথোপোকথোন তার মোবাইলে রের্কড আছে বলেও দাবি করেন লাভলু মিয়া’।
এদিকে,
নিজেদের গরীব ও কর্মহীন দাবি
করে বিশেষ সহায়তার এই টাকা পাওয়ার
কথা স্বীকারও করেছেন খোর্দ্দকোমরপুর ইউনিয়নের নারী সদস্য নাজমা বেগম ও রিনা বেগম,
আ’লীগ নেতা রুহুল আমিন এবং সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রী শাহানাজ।
আ’লীগ নেতা
রুহুল আমিন বলেন, ‘দীর্ঘ এক যুগ তিনি
ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত¦ পালন করেছেন। বর্তমানে নানা কারণে তার সাংসারিক অবস্থা ভালো নয়। ছেলে ও মেয়ে চাকরী
করলেও তারা বেকার হয়ে বসে আছেন। তাই উপায় না পেয়ে তালিকায়
নাম দিয়েছেন তিনি। ঈদের পরে তার মোবাইলে টাকাও এসেছে বলে জানান তিনি’।
ইউনিয়নের সাবেক
চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের স্ত্রী শাহানাজ বেগম মোবাইলে টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘তার স্বামী মারা যাওয়ায় বর্তমান চেয়ারম্যান ও মেম্বার তার
নাম মোবাইল নম্বর তালিকাভুক্ত করেন’। তালিকায় নয়-ছয় আর স্বজনপ্রীতির
এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে খোর্দ্দকোমরপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন ম-ল বলেন,
‘ত্রাণ বিতরণ আর ২৫০০ টাকার
তালিকাতে যে অনিয়ম হয়েছে
তাতে শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে ব্যাহত হচ্ছে। পুরো ইউনিয়নজুড়েই নানা অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির ঘটনা
ঘটলেও নিজ ইচ্ছে ও খেয়ালখুশি মতো
পরিষদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন চেয়ারম্যান। দ্রুত এসব অনিয়মের অভিযোগ সুষ্ঠ তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্ত শাস্তির দাবিও জানান তিনি’।
সুবিধাভোগীদের কাছে
টাকা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘রমজান মাসে অল্প সময়ের মধ্যে তালিকা তৈরী করতে গিয়ে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। আ’লীগ নেতা,
পরিষদের সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের দেওয়া নাম সমন্বয় করে ৫৯৪ জনের তালিকা জমা দেয়া হয়। তবে তালিকা পাঠানোর পর তথ্য কেন্দ্রে
মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে রাজ্জাকের নাম্বার দেয়া হয়েছে।
ঘটনাটি পরবর্তীতে জানার পর রাজ্জাক ও
উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া তার মেয়ের নাম্বারে আসা টাকা ভুক্তভোগীর কাছে দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি’। তবে অভিযুক্ত
রাজ্জাকের দেয়া মোবাইল নম্বরে বারবার কল করেও কেউ
রিসিভ করেনি। অভিযোগের বিষয় জানতে বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি রাজ্জাককে’।
তালিকায় নয়-ছয় আর অনিয়মের
অভিযোগের বিষয় জানা আছে জানিয়ে সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নবীনেওয়াজ বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া
এমন অনিয়মের সাথে জড়িতদের কোন ছাড় নেই জানিয়ে গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্লাপুর-পলাশবাড়ী)
আসনের সংসদ সদস্য এ্যাড. উম্মে কুলসুম স্মৃতি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নগদ সহায়তার তালিকায় অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা
তদন্ত করা হবে। তদন্ত করে এরসাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
গাইবান্ধা
জেলার হতদরিদ্র ও কর্মহীন ৭২
হাজার পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আড়াই হাজার টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এ পর্যন্ত জেলার
সাত উপজেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবার
সহায়তার এই টাকা পেয়েছেন
বলে জানায় জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থা
কার্যালয় ।
0 মন্তব্যসমূহ