সাজ্জাদ হোসাইন শুভঃ
কক্সবাজারের সুবিশাল সমুদ্র সৈকত, হিমছড়ির পাহাড় আর ঝরনা কিছুই যেন মনের খোরাক মেটাতে পারছিলো না। এ যাত্রায় অতৃপ্তির ঢেকুর যেন রয়েই গেলো। সেই অতৃপ্তি থেকেই পরিকল্পনা হলো মহেশখালী থেকে ঘুরে আসার।
দিনটি ছিলো শুক্রবার। শীতের সকাল, ঘড়ির কাঁটায় ৮টা বাজার আগেই হোটেল থেকে চেকআউট করে আমরা বেরিয়ে পড়ি মহেশখালীর উদ্দেশ্যে। কক্সবাজার শহরের কলাতলী মেইন রোড থেকে একটি অটোরিকশায় উঠে পড়ি বাঁকখালী লঞ্চঘাট (৬ নম্বর জেটি ঘাটের) উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালনাধীন ওই ঘাট থেকেই যেতে হয় দ্বীপ মহেশখালী।মাঝবয়সী অটোরিশাচালক গল্প করতে করতে শহরের অলি-গলি পেরিয়ে আধ ঘণ্টার মাথায় আমাদের নামিয়ে দিলেন ঘাটে। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯টা। পেট চোঁ চোঁ করছে ক্ষুধায়। সফরসঙ্গী ঘরের ঘরণী পরামর্শ দিলেন কিছু খেয়ে নিতে। ঘাটের একটি হোটেলেই সেরে নিলাম সকালের নাস্তা।
দিনটি ছিলো শুক্রবার। শীতের সকাল, ঘড়ির কাঁটায় ৮টা বাজার আগেই হোটেল থেকে চেকআউট করে আমরা বেরিয়ে পড়ি মহেশখালীর উদ্দেশ্যে। কক্সবাজার শহরের কলাতলী মেইন রোড থেকে একটি অটোরিকশায় উঠে পড়ি বাঁকখালী লঞ্চঘাট (৬ নম্বর জেটি ঘাটের) উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালনাধীন ওই ঘাট থেকেই যেতে হয় দ্বীপ মহেশখালী।মাঝবয়সী অটোরিশাচালক গল্প করতে করতে শহরের অলি-গলি পেরিয়ে আধ ঘণ্টার মাথায় আমাদের নামিয়ে দিলেন ঘাটে। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯টা। পেট চোঁ চোঁ করছে ক্ষুধায়। সফরসঙ্গী ঘরের ঘরণী পরামর্শ দিলেন কিছু খেয়ে নিতে। ঘাটের একটি হোটেলেই সেরে নিলাম সকালের নাস্তা।
এরপর এগোতে থাকি ঘাটের দিকে। যতই এগোচ্ছি ততই বাড়ছে কোলাহল। লোকে লোকারণ্য। শুক্রবার হওয়ায় অতিরিক্ত পর্যটকের আগমনে ঘাটে দাঁড়ানোরই যেন ফুরসত নেই। এখান থেকে সাধারণত স্পিডবোটেই যেতে হয় মহেশখালী।এদিকে অধিক যাত্রীর উপস্থিতি টের পেয়ে নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত ভাড়া আর রিজার্ভ ছাড়া ঘাট ছাড়ছে না তারা।
পড়লাম বিপাকে, দুইজনে স্পিডবোট ভাড়া করলে বেড়ে যাবে ভ্রমণ ব্যয়। এ চিন্তায় এদিক ওদিক হাঁটা-হাঁটি করতে করতেই একজন বললেন তাদের দলে আটজন আছেন আমরাসহ গেলে ১০ জন হবে। একটা বোট রিজার্ভ করে নেওয়া যাবে, প্রস্তাব দেওয়া মাত্র সায় দিলাম। কথা হলো পুরো বোটের ভাড়া ১২শ টাকা। (যদিও অন্যদিন জনপ্রতি ভাড়া ৬০ থেকে ৭০ টাকা)।
অবশেষে শুরু হলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত মহেশখালী যাত্রা। বোটে থাকা অপর আটজন এসেছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। মিনিট কয়েকের মাথায় তাদের সঙ্গেও বেশ জমে উঠে। বাঁকখালী নদীর নীল জলের মাঝ দিয়ে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে আমাদের স্পিডবোটটি। নদীর জল কণা এসে পড়ছে গায়ে, দূরে সবুজ বন, নদীর পাড়ে বসেছে সাদা বকের মেলা, মাথার উপরে উড়ছে গাঙচিল, ক্যামেরাতো আর ব্যাগে রাখা যায় না। এবার যন্ত্রটি বের করতেই হবে, না হলেতো হাতছাড়া হবে বাঁকখালী নদী পাড়ের মোহনীয় রূপ।
ক্যামরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখতে রাখতেই কেটে কেটে গেলো মিনিট পনেরো। দূর থেকে চোখে পড়লো একটি স্থাপনা। বোটের চালক জানালেন আমরা এসে পড়েছি। দূরে যেটি দেখা যাচ্ছে সেটিই মহেশখালী দ্বীপে নামার জেটি।
কিছুক্ষণ পরেই জেটিতে ভিড়লো আমাদের বোটটি। এক এক করে নামলো দলের সবাই। বোটের ভাড়া মিটিয়ে কয়েকটি সিঁড়ি পেরিয়ে জেটির উপরে উঠে চারদিকে তাকাতেই যেন চোখে পড়ে অন্যরকম রুপ। সবুজ বন, নীল জলে সাজানো সারিসারি সাম্পান। সৃজিত বন দেখে প্রথম পলকেই মনে হয়েছে সুন্দরবনে এসে পড়েছি।
প্যারাবন বেষ্টিত মহেশখালী জেটি বড়ই মনোরম। কক্সবাজার থেকে মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে প্যারাবন দেখতে পাওয়া যায়। সমুদ্র চর আর বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ প্যারাবনের ভেতর প্রবেশ করলেই মুগ্ধ না হয়ে ফেরার সুযোগ নেই।প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ প্যারবন প্রায় ৬০০ হেক্টর জমিতে বাইন, কেওড়াসহ নানা প্রজাতির শ্বাসমূলী উদ্ভিদের ম্যানগ্রোভ বন। গাছের মাথা ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া বকের সারি, পরিযায়ী পাখি দেখে মনে হবে, এ বুঝি আরেক সুন্দরবন। কক্সবাজার-মহেশখালী-কুতুবদিয়া ও সোনাদিয়া উপকূলে যাওয়ার পথে বাঁকখালী নদীর মোহনায় দেখা মেলে এ বনের। এ জেটিকে অনেকেই আবার শুটিং ব্রিজও বলে থাকেন। কোনো একটি বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছিলো এখানে।
জেটির আশপাশ ঘুরে এবার আমাদের যাত্রা মহেশখালীর বাকি স্পটগুলোর দিকে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা বোটের সেই দলের হালিম ভাই, মতি ভাই ও আমরাসহ মোট ৭জন ভাড়া করে নিলাম একটা অটোরিশা। চালকের সঙ্গে চুক্তি হলো তিনি পুরো মহেশখালী ঘুরে দেখাবেন। ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৪৫০ টাকা।
চালক প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেলেন আদিনাথ মন্দিরে। মৈনাক পর্বতের উপরে এ মন্দিরটি। মন্দিরে উঠার আগেই চোখে পড়লো রঙ্গিন মসলা দিয়ে সাজানো পান। একজন বললেন মহেশাখালী এসে সবাই এ পান খেয়ে যান। মহেশখালীর মিষ্টি পানের সুখ্যাতি রয়েছে বিশ্বজোড়া। খিলি প্রতি ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকায় বিক্রি হয় এ পান। এক খিলি পান মুখে নিয়ে পরখ করে দেখলাম মহেশখালীর মিষ্টি পান। পানের মিষ্টি রসের স্বাদ নিতে নিতেই উঠতে থাকি আদিনাথ মন্দিরে।
আদিনাথ মন্দির গড়ে উঠেছে মৈনাক পাহাড়ের ওপর। তাই এর আরেক পরিচয় আদিনাথের পাহাড় হিসেবে। মৈনাক পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত পাকা সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়িপথের বাম পাশ ধরে সারি বেঁধে তাঁতের কাপড়ের দোকান। স্থানীয় তাঁতে বোনা ও বার্মিজ পণ্যের এসব দোকানে বিক্রেতা প্রায় সবাই রাখাইন তরুণী। দোকানে দোকানে শোভা পাচ্ছে রঙ-বেরঙের তাঁত কাপড়ের সম্ভার। আমরা ঠিক করলাম প্রথমে পাহাড় চূড়ায় উঠবো। ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া সেই পথ ধরে চূড়ায় উঠে যাই।
চূড়ার একপাশে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলে গেছে সংকীর্ণ ট্রেইল। চূড়ায় দাঁড়িয়ে দূরে সাগর আর উপকূলীয় বন দেখা যায়। নিচে পাহাড়ের পাদদেশে পানের বরজও চোখে পড়ে। নামার পথে পাহাড়ের মধ্যখানে আদিনাথ মন্দির। ভেতরে পাকা মেঝের এক পাশে বসার জন্য একসারি বেঞ্চ। তারপর দেওয়ালের অন্য পাশে পাহাড়ের খাদ নিচে নেমে গেছে। একটু সামনে গিয়েই মূল মন্দির আর শিবলিঙ্গ। মন্দিরে ডোকার সময় জুতো রেখে যেতে হয়।পাঁচ টাকার বিনিময়ে জুতো পাহারা দেন দু’জন নারী। মন্দিরে গিয়ে দেখা যায় অনেক পূণ্যার্থী ও পর্যটক উপাসনা করছেন।কথা হয় ষাটোর্ধ্ব এক পুরোহিতের সঙ্গে, তিনি জানালেন মহেশখালী উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে দেবতা মহেশের নামানুসারে। মৈনাক পাহাড়ের প্রায় ৩০০ ফুট উচ্চতায় আদিনাথ মন্দিরের অবকাঠামো ষোড়শ শতাব্দীতে গড়ে উঠেছিলো বলে ইতিহাস বিদদের অভিমত।
রামায়ণের বর্ণনা মতে, ত্রেতাযুগে রামকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য রাবণ শিবের উপাসনা শুরু করে অমরত্ব চাইলেন।শিব রাবণকে শর্ত দিলেন, কৈলাস শৃঙ্গ থেকে শিব লিঙ্গ মাথায় করে লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে পূজা করতে হবে। পথে কোথাও রাখা যাবে না। রাখলে আর উঠানো যাবে না। যাত্রাপথে রাবণ এই মৈনাক পাহাড়ে শিবকে রেখে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে যান। কিন্তু ফিরে এসে পুনরায় মাথায় ওঠাতে চাইলে আর ওঠানো গেলো না। মৈনাক পাহাড়েই হয়ে গেলো শিবের অবস্থান। মন্দিরে যাতায়াত হতো নাগা সন্ন্যাসীদের। তাদের একজন ছিলেন গোরক্ষনাথ। যার নামেই মহেশখালী উপজেলা সদরের নাম গোরকঘাটা। হরিপদ নামের স্থানীয় একজন জানালেন প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে আদিনাথে শিব চতুর্দশী মেলা বসে। চলে ১৩ দিন ধরে। তখন দেশ-বিদেশ থেকে পূণ্যার্থীর ঢল নামে।এরপর আমাদের গন্তব্য বড় রাখাইন পাড়া। সে পাড়াতে রয়েছে বেশ কিছু বৌদ্ধ স্বর্ণ মন্দির। বান্দরবানের স্বর্ণ মন্দিরে মতো দেখতে মন্দিরগুলোও বেশ সাজানো গোছানো। কয়েকটি মন্দির ঘুরে এবার আমরা চলে আসি মহেশখালীর শুঁটকিপল্লিতে। সেখানে রোদে শুকানো হচ্ছে বিভিন্ন মাছের শুঁটকি। দেখেই বোঝা যায় এখানকারের শুঁটকির স্বাদ কেমন হবে। গোরকঘাটা বাজারের মং শুঁটকি বিপনিবিতান থেকে শুঁটকি কিনেই ফিরে আমাদের দলের সদস্যরা।
মহেশখালীর গল্প করলে সোনাদিয়ার কথা বলতেই হবে। মহেশখালী উপজেলার অর্ন্তগত কুতুবজোম ইউনিয়নে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এটি জীববৈচিত্রের দ্বীপ নামেও পরিচিতি এবং এ দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপিপাসুদের জন্য অন্যতম পর্যটন স্থান। চারদিকে গভীর সমুদ্রের সাগরের ঢেউ সমৃদ্ধ এটি মূলত প্যারাদ্বীপ নামে পরিচিতি।
যেভাবে যাবেন:
কক্সজবাজার শহরের যেকোন জায়গা থেকে মহেশখালী যাবার বাঁকখালী ঘাট (৬ নম্বর ঘাট) চলে আসুন। তারপর লোকাল ট্রলার বা স্পিডবোটে ৭০-৮০ টাকা ভাড়ায় মহেশখালী আসবেন। আর অন্য পথে যেতে আপনাকে চট্টগ্রাম থেকে সড়ক পথে চকরিয়া এসে বদরখালী হয়ে মহেশখালী আসতে হবে। এ পথে মহেশখালী আসতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে।
থাকার ব্যবস্থা:
এখানে থাকার তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই দিনে দিনে ভ্রমণ শেষ করে কক্সবাজার ফিরে আসতে হবে।
দ্বীপের ইতিহাস:
১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দের প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়। একজন পর্তুগিজ ভ্রমণকারী আরাকান অঞ্চলে এই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ