আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখনো বাংলাদেশের নামের আগে ‘ডিজিটাল’ শব্দটি যুক্ত হয়নি। প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে শুনতাম এই পাড়ার অমুকের মেয়ে সেই পাড়ার তমুকের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে। বাবা-মায়েরা এখনকার যুগের মতো উদার ছিলেন না। প্রেমের বিয়েতে তাঁদের ছিল ঘোর আপত্তি।
এমন অবস্থায় একদিন শুনলাম আমাদের পাড়ার মজনু ভাই পালিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছেন। মজনু ভাইয়ের কথা একটু বলে নিই। পড়াশোনার ধারেকাছে তিনি কখনোই ছিলেন না। ওনার বাবা অনেক কষ্ট করে মুদি দোকান চালিয়ে সংসার চালান আর মজনু ভাই সিনেমার নায়কের মতো চুল আর চিপা জিনস পরে স্টাইল মেরে সারা দিন পাড়ার মোড়ে আড্ডা মারেন। পাড়ার প্রায় সব বড় আপুদের প্রেম নিবেদন করে এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নামের মান রেখেছিলেন।
একে তো পালিয়ে বিয়ে, তারপর মজনু ভাই। কাজেই পাড়ার সব ছোট-বড় মিলে আমরা হই হই করে বউ দেখতে গেলাম। বউ দেখে মাথা নষ্ট। এ তো দেখি অনেক ছোট মেয়ে। জানলাম ক্লাস নাইনে পড়ে। মানে আমার সমবয়সী। মজনু ভাইয়ের সঙ্গে বয়সের বিশাল গ্যাপ। তা ছাড়া মেয়েটা দেখতেও বেশ সুন্দর। মজনু ভাইয়ের মতো ছেলের পাশে ঠিক মানায় না। জানা গেল, মজনু ভাই রিসেন্টলি রংপুরের হারাগাছের কোনো এক বিড়ি ফ্যাক্টরির বিড়ি বিক্রির এজেন্ট হয়ে ওই মেয়ের গ্রামের বাড়ির দিকে যেতেন। স্কুলে যাওয়া-আসার পথেই প্রেম। আর অল্প দিনের প্রেমেই পালিয়ে বিয়ে।
মজনু ভাইদের বাড়িটা আমি যেখানে অঙ্ক স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতাম, সেই স্যারের বাড়ির পাশেই ছিল। যাওয়া-আসার পথে টুকটাক কথা বলতে বলতে মেয়েটার সঙ্গে আমার ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জানলাম, ওরা অনেক ভাইবোন। বাবা বর্গাচাষি। ওর ছোট একটা বোন হতে গিয়ে মা মারা গেছে। সৎমা আছে। অনেকটা সৎমায়ের অত্যাচারের জন্য আর ভালো থাকার লোভে সে পালিয়ে মজনু ভাইকে বিয়ে করে। মজনু ভাইরা যে ওদের মতোই অনেক গরিব, এটা ওর ধারণা ছিল না। এখানে এসে ওর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে, এটাও তার কল্পনার বাইরে ছিল। মেয়েটার জন্য কেন যেন আমার মায়া লাগত খুব।
ক্লাস নাইনে পড়ুয়া বয়সটাই আসলে ভুল করার বয়স। কিন্তু সেই ভুলের মাশুল যে এভাবে ওকে দিতে হবে তা কখনোই ভাবিনি।
দিন যায়, ওর চেহারার পরিবর্তন টের পাই। শুকিয়ে কাঠি। কাপড়চোপড় কেমন যেন মলিন। সব থেকে ভয়ংকর হলো, প্রাইভেট পড়ার সময় প্রায়ই ‘ওরে বাবা রে, মা রে, মরে গেলাম রে’ জাতীয় হাউমাউ কান্নার শব্দ শুনতাম। স্যার বলেন, আহারে মেয়েটাকে এই জানোয়ারগুলো মেরেই ফেলবে। স্যারসহ আশপাশের নাকি সবাই নিষেধ করতে গিয়েছিল, কিন্তু তারা মুখ খারাপ করে গালাগাল করে, অপমান করে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল।
মেয়েটাকে একদিন দেখি চোখের কাছে কালসিটে দাগ নিয়ে বাড়ির কোণে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই বলল, জানো, এরা আমাকে দুই লাখ টাকা বাসা থেকে এনে দিতে বলে। আমি মরে গেলেও তো আমার বাসার কেউ ২০০ টাকা দিয়ে কাফনের কাপড় কিনবে না, দুই লাখ তো দূরের কথা।
খুব খারাপ লাগত আমার। কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলতাম, জানো, আমার দাদি বলেন যে সব মানুষের সবকিছুর কোটা আছে। সুখের কোটা, দুঃখের কোটা, এমনকি খাওয়ার কোটা। এখন বেশি চিনি খেলে নাকি আমার চিনির কোটা শেষ হয়ে জীবনের পরের দিকে ডায়াবেটিস হয়ে যাবে। তোমারও দুঃখের কোটা একদিন শেষ হবে, সেদিন থেকে তোমার শুধু সুখ থাকবে।
ওই দিন রাতে আমি ঘরে পড়ছিলাম। হঠাৎ শুনি উঠোনের জানালায় কে যেন নক করছে। আমার আবার ভূতের ভয় মারাত্মক। দাদিকে ডাকব কি না ভাবছি। ওদিকে জানালায় নারী কণ্ঠ বারবার বলছে, দরজাটা খোল। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। শব্দে দাদিরও ঘুম ভেঙে গেছে। খুলে দেখি রংপুরের ওই কনকনে শীতের রাতে পাতলা একটা সালোয়ার–কামিজ পরে দাঁড়িয়ে আছে আমার বন্ধু। সারা শরীরে মারের দাগ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু কাঁদছে। দাদি বললেন, এগুলো কি ইবলিস। আমার স্পষ্ট মনে আছে, দাদি ওকে ভাত খেতে দিলে হাপুসহুপুস করে ভাত খেয়ে সে রাতে ও আমার আর দাদির সঙ্গে এক খাটে ঘুমিয়েছিল। দাদি ঘুমিয়ে গেলেও আমরা দুই বন্ধু অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম।
পরদিন সকালে পাড়ার গণ্যমান্য কয়েকজন ব্যক্তির উপস্থিতিতে মেয়েটিকে আর অত্যাচার করা যাবে না এই শর্তে মজনু ভাইয়ের বাবা-মায়ের কাছে তুলে দেওয়া হয়।
এর দুই দিন পর জানলাম, মেয়েটিকে তার বাবার বাসায় রেখে আসা হয়েছে। মজনু ভাইরাও কিছুদিন পর আমাদের পাড়া ছেড়ে হারাগাছের দিকে চলে যান। আমিও ধীরে ধীরে পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি প্রথম দিকে মেয়েটির কথা বেশ মনে হলেও ধীরে ধীরে ভুলে গেলাম।
মাস্টার্স করতে ইউরোপে গিয়েছিলাম। কানেকটিং ফ্লাইটের জন্য দুবাই বিমানবন্দরে বসে আছি। থাকতে হবে পাঁচ ঘণ্টা। গল্পের বই, ল্যাপটপ সঙ্গেই এনেছি। বিমানবন্দরে কার্পেটের ওপর পা ছড়িয়ে বই পড়ছি। কিন্তু কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি সুন্দরমতো একটা মেয়ে। একটু হাসি দিয়ে আবার বইয়ে মন দিলাম। একটু পর দেখি মেয়েটা উঠে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, আমি বাংলাদেশের কি না। হ্যাঁ বলতেই বলল, আমার নাম কি ‘জিনিয়া’? আমি বেশ অবাক হলাম। মেয়েটা হেসে বলল, তুমি কিন্তু একটুও বদলাওনি। তোমার গালের ওই তিলটা দেখেই আমি শিওর হয়েছিলাম যে এটা তুমি। হঠাৎই পুরোনো সব স্মৃতি হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বললাম এত দিন তুমি কোথায় ছিলে? এখন কোথায় যাচ্ছ?
তোমার মনে আছে, আমাকে ওরা বাপের বাসায় রেখে আসতে গেল। বাপের বাসায় তো সবাই ধাক্কা মেরে বের করে দিল। মজনুর পা ধরে অনেক কান্নাকাটি করলাম। ওর মন একটু নরম হলো। বলল ঠিক আছে, চল। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসে উঠে বসলাম। সারা দিনের এত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। অনেক পরে চোখ মেলে দেখি বাস দাঁড়িয়ে আছে। মজনু নেই। বাসের লোক বলল, মজনু নাকি অনেক আগেই বাস থেকে নেমে গিয়েছিল। আমার মাথায় কিছু কাজ করছিল না, জানলাম এটা বগুড়া। এত রাতে যাওয়ার কোথাও জায়গা ছিল না। বাসের এক লোক খুব দরদি হয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। বলল, রংপুরে পৌঁছে দেবে। আমাকে পৌঁছে দিল বগুড়ার পতিতালয়ে। পরে শুনেছি ৮০০ টাকায় আমাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
অনেক দিন এ হাত সে হাত ঘুরে ঢাকায় এলাম। বিদেশি এক এনজিও খারাপ অসুখ-বিসুখের জন্য সচেতন করতে এসেছিল আমাদের ওখানে। পড়াশোনা জানা থাকায় ওদের আমি সাহায্য করেছিলাম। আমি এই নোংরা পথ থেকে ফিরে আসার জন্য ওদের কাছে সাহায্য চাই। ফিরে আসাটা এত সহজ ছিল না। আমার তো কোনো দোষ ছিল না। আমি তো এই পথ বেছে নিইনি। আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল।
কিন্তু এ পথ থেকে ফিরে আসার উপায় আমাকেই তৈরি করতে হয়েছে। আমি পেরেছি। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শিখেছি। বেশ কয়েক বছর হলো আমি এনজিওতে কাজ করছি। আমার মতো মেয়েদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছি। আমি এখন সেক্স ওয়ার্কার অ্যাকটিভিস্ট। সেই সূত্রেই লন্ডন যাচ্ছি।
মনে আছে তোমার দাদি বলেছিলেন, দুঃখের কোটা একদিন শেষ হবেই। হ্যাঁ আমি বিশ্বাস করি আমারটা শেষ হয়েছে। আমি এখন অনেক সুখে আছি।
আমার বন্ধুটির লন্ডন যাওয়ার ফ্লাইটের সময় হয়ে এল। বিদায় নেওয়ার সময় জড়িয়ে ধরতেই ও বলল, আমি যে যৌনকর্মী ছিলাম এটা আমি কখনোই লুকাইনি। আমাকে বন্ধু পরিচয় দিতে তুমি কি লজ্জা পাবে? তুমি কি বলতে পারবে যে একজন পতিতার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব ছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কজন পারে তোমার মতো সাহসী হতে? কজন পারে এমন দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে? কজন পারে, এই সব দুর্ভাগা মেয়েদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে? মনোয়ারা পারভিন মুন্নী, আমি সত্যিই তোমাকে নিয়ে গর্বিত।
বি.দ্র: লেখাটি লেখার আগে মুন্নীর অনুমতি নিয়েছিলাম। খুশি মনে অনুমতি দিয়েছিল।
/প্রথম আলো!
0 মন্তব্যসমূহ